Thursday, May 20, 2010

জীবনের কথকতা

লেখা-লেখি আমি খুব একটা করতে পারি না, আসলে পারিই না। কলম দিয়ে পরীক্ষার খাতা আর ক্লাস নোট ছাড়া এখন একটা লাইনও লিখি না বহুদিন।
ইদানিং কালে আমার একটা দরখাস্ত পর্যন্ত লেখার মত চিন্তাও মাথায় আসে না।

আজ সন্ধ্যায় লোডশেডিং হবার পর ছাদে উঠলাম।
আমাদের বাসাটা একতলা, বাড়িটাতে যদিও আমরা ভাড়া থাকি তারপরও সমস্ত বাড়িতে আমরা একাই থাকি। আমাদের বাড়িওয়ালা ঢাকায় দেশের নাম করা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আমারাই থাকি এখানে সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিয়ে। এমনকি এই এলাকায় যারা নতুন ভাড়াটে তারাও সবাই ঠিকমত জানে না যে আমরা এখানে ভাড়া থাকি। প্রথমে তো বটেই অনেক দিন পার হবার পরও তারা জানে না এমন অনেকেই আছে। কেননা আমরা এখানকার অনেক পুরাতন ভাড়াটে, মনে হয় এখন সবচেয়ে পুরাতন ভাড়াটেই।

ওহ্‌, যা লেখার জন্য বসলাম তা না লিখে আমি অন্য কথা বলে বেড়াচ্ছি। এটাও অবশ্য আমার না লেখার একটা কারন। কেননা আমি একটা চিন্তা খুব দীর্ঘ সময় করতে পারি না, মূল চিন্তার বিষয়বস্তু থেকে নানা প্রকার শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। শুধু শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেই সে ক্ষান্ত হয় না, এমন একটা সময় আসে যে আমি মূল বিষয়বস্তুটাকেই আর মনে করতে পারি না। এই সমস্যার একটা সমাধান অবশ্য আমাকে আমার এক বড় ভাই দিয়েছেন, তিনি হলেন ফয়সাল ভাই, এবং সমাধানটা হল নামাজ। হ্যাঁ, নামাজ পড়া। নিয়মিত নামাজ পড়া। সমাধানটার মর্মার্থ যদিও আমি বুঝতে পেরেছি, তবুও এখনও প্রয়োগ করা শুরু করিনি। ভাবছি শীঘ্রই শুরু করব। যা হোক আমি আবারো মূল কথা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি।

যাই হোক আমাদের ছাদ থেকে সামনের বাড়ি অর্থাৎ রাস্তার ওপারে যে বাড়ীটা তার নীচতলার ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। ওখানে যে পরিবারটি থাকে তাদের ছোট দুটি ছেলে। ছোট বলতে বড় যে ছেলেটি সে হয়তো টূ বা থ্রি তে পড়ে আর ছোটটি হয়তো ওয়ান বা টূ তে পড়ে। ওদের খোলা জানলা দিয়ে যে দৃশ্যটি আমার চোখে পড়তেই চোখ প্রাথমিক ভাবে আটকে গেল এবং পরক্ষণেই আমাকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল সে দৃশ্যটি হয়তো অনেকের জন্যই খুবই সাধারন দৃশ্য হতে পারে, কিন্তু আমি কেন যেন আটকে গেলাম। একদমই যে কারনটা আমি জানি না তেমন নয়, জানি ঠিকই। আমি জানি সেই কারন যে কারন জানার পর আমি পারব শূধু এমন কোন দৃশ্য দেখে চিন্তায় ভেসে যেতে, আনমনে আফসোস করতে, আর নয়তো আনমনা এই আফসোসের লিখিত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে। কেননা এই কথা আমি কাউকে বললে তার কাছে ঘটনাটা সাধারন লাগতেই পারে। আর কাউকে খুব আগ্রহ নিয়ে বলার পর যদি আশানুরূপ কোন সাড়া পাওয়া না যায় তখন নিজেরই খারাপ লাগবে।

যা হোক আগে তো দৃশ্যের বর্ণনা করতে হবে, তারপরই না আমার কথা...

দৃশ্যটি এমন,
ছোট ছেলেটি খাটের ওপর বসা, আর বড় ছেলেটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে খাটের ওপরেই। দুজনেই খালি গায়ে, একটি হাফ্‌ প্যান্ট পরে আছে। ছেলেদুটির প্রত্যেকের সামনেই বই। তাদের মায়ের একটি হাত পাখা, তা দেয়েই তিনি ছেলে দুটিকে বাতাস করছেন। তাদের বাবা বিছনাতেই অন্য একপাশে, বিছনার যে দিক থেকে উঁচু করে কাঠ দেওয়া থাকে, সে কাঠটিতে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় রয়েছেন।
তাদের সামনে বর্তমানের খুব প্রচলিত লেড-এর ছোট ছোট লাইট দিয়ে বানানো একটি লাইট জ্বলছে। সে আলোতেই বাচ্চাদুটি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। হয়তো গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়ছে না, তারপরও, হয়তো আমার চোখেই তাদের আগ্রহী মনে হয়েছে। তারা পড়ছিল এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মায়ের সাথে নানা ভাবে নানা ভঙ্গিতে আলোচনা করছিলো। কখনও হাত নেড়ে, কখনও বা মায়ের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে, কখনও খাতায় কিছু লিখে, কখনও শুয়ে থাকা ছেলেটি উঠে বসে আরও নানা ভঙ্গিতে। তাদের মায়েরও যেন আগ্রহের কোন ঘাটতি নেই, তিনি তাদের সাথে কথা বলছেন, পড়াচ্ছেন এবং সেই সাথে স্বামী সন্তানকে বাতাস করে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। এভাবেই তারা চালিয়ে যাচ্ছিলো তাদের আলোচনা অনুষ্ঠান এবং অধ্যয়ন পর্ব।

কিছুটা দূর হওয়ায় আমি তাদের কথা শুনতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপরও আমি ওই এলাকায়, অর্থাৎ ওখানেই আমার ওই কৈশোর কাটানোর অভিজ্ঞতার কারনে আমি ভেবে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম তারা কি নিয়ে আলোচনা করতে পারে...আমার অতীত আমাকে সহায়তা করছিলো তাদের কথাগুলোকে শ্রবনযোগ্যতা প্রদানের। আমি যেন শুনতেই পাচ্ছিলাম তাদের কথাগুলো। তাদের সকল হাসি-আনন্দ, কথা-বার্তা ছুঁয়ে যাচ্ছিলো আমাকে।

হয়তো আজকে দিনে তাদের স্কুলে ক্লাসে কি ঘটলো, টিফিন-এ কি ঘটলো, বিকালে বাড়ীর সামনের এই রাস্তায় খেলার সময় কি ঘটলো এই কথা। হয়তো আরও অন্যান্য অনেক কথা।

এই ঘটনাটি দেখেই আমার মনে পড়ে গেল ওই বয়সের অন্য এক গল্পের কথা...

আমরা তিন ভাই, কোন বোন নাই। কথাটা আমার কাছে একটা ছন্দের মতন। এভাবেই আমি মোটামুটি আমাদের তিন ভাইয়ের কথা বলি। আমার বাবা আগে শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন, মংলা পোর্ট-এ। সে অনেক দিন আগের কথা। আগের কথা বলতে, যে দৃশ্যের বর্ণনা কছুক্ষণ আগে আমি দিলাম সে দৃশ্যের বড় ছেলেটির বয়সের কথাই বলতে গেলে। কেননা এর পরই মংলা পোর্ট কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আর আমার বাবার চাকরিও আর থাকে না। ভাইদের ক্রমের দিক থেকে আমার অবস্থান দ্বিতীয়, অর্থাৎ মেঝ। আমার বড় ভাই দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুদিন পরেই "পরিবেশ বিজ্ঞান"-এ মাস্টার্স পাশ করে যাবে, আর ছোট ভাইটা বিগত বারেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও কোথাও চান্স পায়নি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মোটামুটি পরিচিত একটি কলেজে "ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাঙ্কিং" ভর্তি হয়েছে, এবার আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "গ" ইউনিট-এর জন্য আবার চেষ্টা করবে। আর মা গৃহিনী। মোটামুটি এটুকুই আমাদের পাঁচ জনের পরিবার।

সে সময় আমরাও সবাই ছাত্রই ছিলাম। ভাইয়ার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছর হলেও ছোট ভাইয়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র দেড় বছর। বাপ্পি কিছুদিন পর পর বাসায় আসতো। বাবাকে আমরা তিন ভাই-ই বাপ্পি বলি। আম্মাই আমাদের সাথে সবসময় থাকতেন। সে সময়টাতে ছাত্র হওয়ায় সবারই পড়াশোনা করতে হত মোটামুটি নিয়মিত। মা আমার গৃহিনী হলেও তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত, বি-এ, বি-এড। "বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক"-এ সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি পাওয়ার পর আমার দাদা চাকরি করার অনুমতি না দেওয়ায় আর চাকরি করে নি আম্মা।

যাই হোক আর ভালো লাগছে না লিখতে। শুধু এটুকুই বলতে চাই ওই সামনের বাড়ীতে দেখা দৃশ্যের মত কিছু স্মৃতি আমারও আছে। আছে কিছু সুখস্মৃতি। আছে আনন্দের কিছুক্ষণ।

আম্মা আজ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ, খুব অসুস্থ, মাথা তুলে সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না, সবকিছু ঠিকমত মনে রাখতে পারে না। আমি কলেজে থাকা অবস্থাতেই আম্মা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে, দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আম্মা বর্তমানে নানা বাড়ি আছে। আমার নানা বাড়ি নরসিংদী। নিরসিংদীতে আম্মাকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। আজ আড়াই-তিন মাস ধরে আম্মা ওখানেই।

আজ আমরা পাঁচ জন পাঁচ জায়গাতে আছি,

আম্মা নানা বাড়ি
বাপ্পি চাকরিতে, নারায়নগঞ্জ
ভাইয়া তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-এ
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-এ
ছোটভাইটা বাসায়

আজ যখন ছাদে উঠে ওই দৃশ্য দেখছিলাম তখন ছোটভাইটা আমার সাথেই ছিলো। হঠাৎ ই চুপ করে যাওয়ায় সে আমাকে বলে যে এটা নিয়ে ভেবে কি লাভ? কি হবে এসব ভেবে? কেমন করে তুমি সবাইকে এক করবা?

আমি খুঁজে পাই নি কোন উত্তর, দিতে পারি নি কোন জবাব। ও আমাকে বলছে, এই যে আজ আমরা দুজন আজ একসাথে আছি এটাই কত! এসব কিছুর পরও ভাবা ছাড়া আমার কাছে আর কোন উত্তর ছিল না।

কয়েক ঘন্টা পর, আবারো লোডশেডিং, আমরা আবারো ছাদে...

ছোট ভাইটির কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ওকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করছিলাম। তখন এক পর্যায়ে ও বলল এই যে আজ আমরা তিনভাই যে আজ ছাদের উপর একসাথে কতদিন পর ভাবতো, আবার কবে একসাথে ছাদের উপর উঠব তা কি বলতে পারবা? হ্যাঁ, ভাইয়া এসেছে কছুক্ষণ আগে।

কথাটা বলতেই আবারো আমি কিছুটা থমকে গেলাম, আসলেই তো তাই, আবার কবে আমরা এই ছাদের উপর একসাথে হব তা নিজেও জানি না। কেননা ভাইয়া বাসাতে থাকলেও আমি থাকছি না আর, কালই আমি রওনা হব ঢাকার উদ্দেশ্যে।

আমার কাছে এখন জীবনটাকে মনে হয়, এক দ্রুতগামী ট্রেন কিংবা বাসের মত।
কেননা যতক্ষণই ছুটে চলছি ততক্ষণ পিছু ফিরে তাকাবার সময় নেই, সময় নেই অতীতকে কাছে টানবার, তাকে নিয়ে ভাববার, শুধুই ভুলে থাকা।

তাই ট্যুর-এ যাই কিংবা ঘুরতে যাই, কখনও সবান্ধব কখনও একা।
অতীতের সুখস্মৃতি যতটা না আনন্দ দেয়, বেদনা দেয় শতগুণ।
এই কয়েক বছরে ঘটে গেছে কত না মজার ঘটনা, কিছু আছে কষ্টেরও। তবে জীবন বদলেছে অনেক। হয়তো অন্য কোন দিন লিখতে ইচ্ছা করলে আবার কিছু লিখবো। তবে আশা করি ইচ্ছা করবে না।

আমার কখনওই নিজের কথা লিখতে ইচ্ছা করে না, লিখতামও না, শুধুমাত্র ফয়সাল ভাইয়ের কারনেই লেখা। আমার এই লেখা তাই ফয়সাল ভাইকেই উৎসর্গ করছি, কেননা উনিই চান আমি যেন নিজের কিছু লিখি। লেখার শাখা-প্রশাখা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। কারন আমি যে আসলে কি লিখতে চেয়েছিলাম আর কি লিখেছি তা নিজেই জানি না। তবে লেখার আকৃতি দেখে আমি এবার বেশ ভালই ধাক্কা খেলাম, আর আকৃতির কথা না হয় না-ই বললাম। কেননা এই লেখা থেকে আমাকে যদি সারাংশ বের করতে দেওয়া হয় তবে আমার দ্বারা তা কখনই সম্ভব না।
একারনেই পত্রের বিদায় সম্ভাষণের মত বলতে হয়,
আজ আর নয়।।


১৮-০৪-২০১০ ইং
০৬:১৬ সকাল